পিসিবির ইতিবৃত্ত

পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল (পিসিবি) সম্পর্কে ১৮৭৬ সালে প্রথম ধারণা প্রদান করেন জার্মান রসায়নবিদ জনাব অস্কার ডয়েবনার। ১৯২৯ সালে পিসিবি এর প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় এবং ১৯৩০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন: ট্রান্সফর্মার, ক্যাপাসিটর ইত্যাদিতে ব্যবহার শুরু করা হয়। সত্তর দশকে বিজ্ঞানীগণ পর্যবেক্ষণ করেন যে, পিসিবি মানুষের শরীর এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

পিসিবি অধিক তাপ সহনশীল হওয়ার কারণে এক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য  কুলিং এজেন্ট  হিসেবে “ট্রান্সফরমার তেল” ব্যবহার করা হয়েছে । এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পদার্থ ও পরিবেশের উপর  দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারের কারণে ১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাপী এর উৎপাদন বন্ধ করা হয়। ১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাপী পিসিবি এর উৎপাদন বন্ধ হলেও বিভিন্ন সময়ে প্রস্তুতকৃত ট্রান্সফর্মারে উচ্চ মাত্রার পিসিবি রয়ে যায়। এছাড়াও ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পিসিবি উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

বাংলাদেশ পিসিবি উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু সত্তর দশকের দিকে বাংলাদেশে পিসিবিযুক্ত ট্রান্সফর্মার, ট্রান্সফর্মার তেল ও ক্যাপাসিটর আমদানির ফলে ধারণা করা হয় যে, কিছু কিছু ট্রান্সফর্মার বা ক্যাপাসিটরে পিসিবি রয়েছে। এছাড়াও ট্রান্সফর্মার দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে তেলের পরিমান কমে যায়, সেক্ষেত্রে ট্রান্সফর্মারে বাড়তি তেলে পুর্নঃভরণ করার প্রয়োজন হওয়ার কারণে অনেক সময় পুরাতন ট্রান্সফর্মারের তেল এবং কম পুরাতন ট্রান্সফর্মারের তেল বা অপেক্ষাকৃত নতুন ট্রান্সফর্মারের তেল একত্রে মিশিয়ে সেন্ট্রিফিউজ করে ট্রান্সফর্মারে তেল পুনরায় পুর্নঃভরণ করা হয়। পুরাতন ট্রান্সফর্মারের তেলে পিসিবি থাকলে তা অন্য ট্রান্সফর্মারের তেলে ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। বৈশ্বিকভাবে পিসিবি একটি উদ্বেগের বিষয় বিধায় বাংলাদেশও এই সমস্যার বর্হিভূত নয়। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে পিসিবি ব্যবহার করার ফলে এটি মাটি ও পানিতে মিশে পরিবেশে বিস্তার লাভ করেছে।

চিত্র: ট্রান্সফর্মারের পিসিবি এর উপস্থিতির স্থান।

পলিক্লোরিনেটেড বাই-ফিনাইল (পিসিবি) মানবসৃষ্ট একটি জৈব রাসায়নিক যৌগ।   পিসিবি বর্ণহীন ও উচ্চ তাপমাত্রায় সহনশীল রাসায়নিক পদার্থ। পিসিবি-এর ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণের জন্য এটি এক সময় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার ও ক্যাপাসিটরে কুলিং এ্যাজেন্ট  হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পিসিবি খুব সহজে ভেঙ্গে যায়না বা হ্রাস পায় না। ফলে পরিবেশে দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকে। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য পিসিবিকে Persistent Organic Pollutants (POPs) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিসিবি মাটি ও পানিতে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশের মাধ্যমে জীবদেহের ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।

Persistent Organic Pollutants (POPs) একটি জৈব রাসায়নিক যৌগ যা পরিবেশে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এটি মানুষের শরীর এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। POPs পরিবেশের আসলে তা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশের মাধ্যমে জীবদেহে প্রবেশ করে। POPs এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো, এটি জীবদেহের চর্বিযুক্ত টিস্যুতে দীর্ঘদিন অবস্থান করে, যা জীবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া মাটি, পানি, বায়ু ও জীবের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। জীবদেহে দীর্ঘদিন অবস্থান এবং ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে POPs বিশ্বব্যাপী হুমকিস্বরূপ।

পলিক্লোরিনেটেড বাই-ফিনাইল (পিসিবি) পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে জানুয়ারি, ২০০৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক National Implementation Plan of Persistent Organic Pollutants (POPs) প্রণয়ন করে স্টকহোম কনভেনশন এর সেক্রেটারিয়েট এ দাখিল করা হয়েছে। দেশে বিদ্যমান পিসিবি এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে পিসিবির পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে Global Environment Facilities (GEF) এর অর্থায়নে এবং United Nations Industrial Development Organization (UNIDO) এর কারিগরি সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর “Environmentally Sound Development of the Power Sector with the Final Disposal of Poly Chlorinated Biphenyls (PCBs)” প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ:

১)   পরিবেশসম্মত পিসিবি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা;

২)   পিসিবিযুক্ত ৫০০ টন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করা;  

৩)   স্টকহোম কনভেনশনের পিসিবি সম্পর্কিত বাধ্যবাধকতা প্রতিপালনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ।

এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎ সেক্টরের সংস্থাসমূহে পিসিবি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সম্মতভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং সচেতনতা কার্যক্রম আয়োজন করা। বিদ্যুৎ সেক্টরের ০৭টি সংস্থা এ প্রকল্পের সহযোগী বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। যথা:

ক) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)

খ) বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)

গ) ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (ডিপিডিসি)

ঘ) ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (ডেসকো)

ঙ) পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)

চ) ওয়েষ্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (ওজোপাডিকো)

ছ) নদার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (নেসকো)

আসুন, বিশ্ব স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা করার জন্য বাংলাদেশকে পলিক্লোরিনেটেড বাই-ফিনাইল (পিসিবি) মুক্ত করি।